রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
তিতাসে দুর্নীতির সাক্ষী যখন পাইপ

তিতাসে দুর্নীতির সাক্ষী যখন পাইপ

স্বদেশ ডেস্ক:

অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ প্রায়ই তাদের লাইনে যুক্ত অনুমোদনহীন পাইপসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করে থাকে। বিধি অনুযায়ী এসব মাল তিতাসের সংশ্লিষ্ট গুদামে জমা হওয়ার কথা; কিন্তু তিতাসের সোনারগাঁও ও ডেমরা জোনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সে পথে যাননি। তারা পরস্পরের যোগসাজশে প্রায় অর্ধকোটি টাকার পাইপসহ অন্যান্য মাল নিজেরাই বিক্রি করে পুরো টাকা পকেটে পুরেছেন। আর এ কা- আড়াল করতে তারা ভুয়া কিছু দাপ্তরিক নথিপত্র তৈরি করেন, যেখানে দেখানো হয়েছে- মালপত্র গোডাউনে জমা দেওয়া হয়েছে। এ তো গল্পের এক পিঠ- লোভে করা পাপের গল্প। অন্য পিঠের গল্পটি পাপে যে মৃত্যু, তা নিয়ে। কারণ শেষ পর্যন্ত গোপন সেই কুকর্ম থাকেনি গোপনে। কীভাবে? মালামাল বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকার বাটোয়ারা নিয়ে শুরু হলো সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের জেরেই অবৈধভাবে টাকা কামানোর কুকীর্তি পৌঁছে গেল তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কানে। এর পরই টনক নড়ে মালপত্র বিক্রি ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের। নিজেদের রক্ষায় বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা পাইপসহ অন্যান্য মাল সংগ্রহে নেমে পড়েন এবং সত্যি সত্যি তিতাসের গুদামে সেসব মাল ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন; কিন্তু ততদিনে সজাগ হয়ে গেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। গোঁজামিল দেওয়ার জন্য কেনা মালপত্র কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গোডাউনে ঢুকাতে দেওয়া হয়নি। এর পর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ভীষণ বিপাকে পড়েছে মালপত্র আত্মসাতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

কীভাবে তিতাস সূত্রের খবর, এ কা-ে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল তিতাসের মানবসম্পদ শাখা থেকে এ বিষয়ে জারিকৃত অফিস আদেশে উল্লেখিত বখাস্ত ৪ জন হলেন- তিতাসের ডেমরাস্থ পাইপইয়ার্ড গোডাউনের দায়িত্বে থাকা উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভা-ার) মাসুদুর রহমান, সিনিয়র স্টোরকিপার মো. ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারি, সোনারগাঁও জোনের সহকারী ম্যানেজার সারওয়ার জোয়ার্দার, অফিস সহকারী মো. জহিরুল ইসলাম।

এদিকে এ কা-ের তদন্তে কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে। কমিটিকে বলা হয়েছে ১০ দিনের মধ্যে তদন্তপূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে। এ কমিটিতে

আছেন তিতাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউসুফ, ব্যবস্থাপক মো. মাহমুদ উর রহমান ভূঞা ও ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবু বকর।

এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নরুল্লাহ

আমাদের সময়কে বলেন, কোনো অনিয়মের ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি কার লোক, কী পরিচয়- এসব আমরা গুরুত্ব দেব না। অনিয়মকারীর হয়ে কেউ তদবির করলে ওই তদবিরকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সরকারি পাইপ বিক্রি করে দেওয়া গুরুতর অপরাধ। দীর্ঘদিন যাবৎ নানা অনিয়ম করে তারা সাহস সঞ্চয় করেছে বলেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনার সঠিক তদন্ত হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্রমতে, গত ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অফিস থেকে স্থানীয় একটি রি-রোলিং মিলে বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন সময়ে অবৈধ গ্যাস পাইপলাইনের বিরুদ্ধে চলা অভিযানে জব্দকৃত অর্ধকোটি টাকার মালপত্র। এর পর অভিযুক্তরা মেটেরিয়াল ট্রান্সফার ভাউচার (এমটিভি) তৈরি করে সেই মালপত্রের কিছু অংশ ঢাকার ডেমরায় তিতাসের কেন্দ্রীয় গোডাউনে জমা হিসেবে দেখায়। এ এমটিভি প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়, যেখানে স্টোরকিপার থেকে শুরু করে উপ-মহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত সবার স্বাক্ষর রয়েছে।

সূত্রমতে, জব্দ করা গ্যাস পাইপলাইন অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়ার প্রধান হোতা মূলত সোনারগাঁও জোনের অফিস সহকারী মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি মালামাল বিক্রি করে এমটিভি তৈরির পর সেটি গোডাউনে জমা দেখাতে দায়িত্ব দেন ডেমরার সিনিয়র স্টোরকিপার মো. ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারিকে। ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারি পর্যায়ক্রমে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে স্বাক্ষর নিয়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া মালাপত্র গোডাউনে জমা দেখানোর কাগজ তৈরি করেন। তবে প্রায় পাঁচদিন আগে বিক্রি হয়ে যাওয়া মালপত্রের টাকা ভাগবাটোয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব হওয়ায় পরে বিষয়টি তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জেনে যান। এ ঘটনায় ডেমরাস্থ তিতাসের পাইপইয়ার্ড গোডাউনের দায়িত্বে থাকা উপ-মহাব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমান ও ব্যবস্থাপক সহিদুল প্রামাণিক তাদের স্বাক্ষতি দুটি এমটিভি বাতিল করতে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে নোট দেন।

তিতাসের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সোনারগাঁও ছাড়াও তিতাসের ডেমরা জোনটি মূলত এই অফিস সহকারীর নিয়ন্ত্রণে। তার ভয়ে সেখানাকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তটস্থ থাকেন। জহিরুল ইসলামের লোকদের বাইরে কেউ কোনো কাজ করতে পারে না। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ খোদ তিতাস কর্তৃপক্ষই জহিরুলের বিরুদ্ধে আনীত একাধিক অভিযোগের তদন্ত করছে।

এদিকে এ ঘটনায় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গত সোমবার বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনটি ছোট পিকআপে করে মালপত্র এনে ডেমরার গোডাউনে ঢোকানোর চেষ্টা করে জহিরুল ইসলামসহ পাইপ বিক্রির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট। মালবোঝাই গাড়িটি পুরো একটি দিন গুদামের গেটে রাখা হলেও কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টির কারণে মালপত্র ঢোকানো সম্ভব হয়নি।

তিতাস সূত্রে জানা যায়, গোডাউনে মালপত্র ঢোকানোর ক্ষেত্রে গেটপাস উপ-মহাব্যবস্থাপক পর্যায় থেকে নিতে হয়। আর অপরাধী চক্রটি এ নিয়ম উপেক্ষা করে সোনারগাঁও জোনের সহকারী ম্যানেজার সারওয়ার জোয়ার্দার স্বাক্ষরিত গেটপাস ইস্যু করেছিল।

সূত্রে জানাযায়, গত ২৬ জানুয়ারি তিতাসের আঞ্চলিক অফিস সোনারগাঁও থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মিটার স্ক্রাপ এমএস পাইপ, এক ডজন ভাল্বপিটসহ অন্যান্য মাল তিতাসের ডেমরা সংরক্ষণাগারে পাঠানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব মাল পাঠানো হয়নি। এসব মাল গোডাউনে জমা না করেই ডেমরার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র রেকর্ড কিপার মো. ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারি মালাপত্রের প্রয়োজনীয় রসিদে (এমটিভি ফরম) স্বাক্ষর করেন। ফরম নাম্বার ১০৫ ও ১০৬।

সূত্রে জানাযায়, ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারি নিজে এমটিভিতে স্বাক্ষর করে সহকারী কর্মকর্তা গাজী সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আনিছুজ্জামান, সহকারী ব্যবস্থাপক মো. রুহুল আমীনের স্বাক্ষর নিয়ে ব্যবস্থাপক মো. সহিদ আলী প্রামাণিক এবং উপ-মহাব্যবস্থাপক মাসুদ উর রহমানের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পরে কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, ম্যাটেরিয়াল ট্রান্সফার ভাউচারের (এমটিভি) মালপত্র ডেমরা ভা-ারে প্রবেশ করেনি। দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নিরাপত্তা বিভাগের রেজিস্টার এবং ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেন- মালাপত্র প্রবেশ করেনি। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডেকে নিয়ে মালপত্র কোথায় গেল জানতে চাওয়া হলে মো. ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারি মালপত্র গ্রহণ না করেই এমটিভি প্রদানের রসিদে স্বাক্ষরের কথা স্বীকার করেন। এর পর তিতাস কর্তৃপক্ষ এমটিভি দুটি বাতিল ঘোষণা করে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877